বুধবার, ০১ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:২৫ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

নবুয়তের ধারা চলমান থাকলে নবী হতেন যিনি

মুফতি আহমাদুল্লাহ মাসউদ:
হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু ছোট থেকেই মার্জিত স্বভাব, ভারী ব্যক্তিত্ব ও সুশৃঙ্খল জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। তিনি সুশিক্ষিত, সাহসী ও অত্যন্ত মানবিক ছিলেন। যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে সুদৃঢ় অবস্থান নিতেন। ছোট থেকেই একজন নবীর স্বভাব-চরিত্রে যেসব বৈশিষ্ট্য থাকে সেসব ওমর (রা.)-এর ভেতরেও ছিল। তাই তো নবীজি (সা.) বলেছিলেন, ‘নবুয়তের ধারা চলমান থাকলে আমার পর ওমর নবী হতো।’

ওমর (রা.) ছিলেন বিস্ময়কর ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তিনি খেলাফতে রাশেদার মধ্যে অন্যতম। তার দক্ষ নেতৃত্ব, ন্যায়বিচারের প্রতি অনমনীয় অঙ্গীকার এবং ইসলামি শাসনব্যবস্থাকে বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করার মহিমা চিরকাল ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে। ওমর (রা.) তাদের অন্তর্ভুক্ত, যাদের সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) দুনিয়াতেই প্রকাশ্যে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। তিনি এমন বহুমাত্রিক গুণাবলির অধিকারী ছিলেন, যার সাক্ষ্য স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সা.) বিভিন্নভাবে দিয়েছেন। এই গুণাবলির কারণেই রাসুলুল্লাহ (সা.) তার ইসলাম গ্রহণের জন্য আল্লাহর কাছে বিশেষ দোয়া করেছিলেন। মহান আল্লাহ সেই দোয়া কবুল করেছিলেন। ফলে তিনি ইসলামের ছায়াতলে প্রবেশ করার পর তার মাধ্যমেই ইসলামের প্রসার ও বিজয় আরও সুদৃঢ় হতে থাকে।

নবুয়তের দরবার থেকে তাকে ‘আল-ফারুক’ উপাধি প্রদান করা হয়, যা উম্মতের অন্য কারও ভাগ্যে জুটেনি। এর অর্থ হলো, সত্য-মিথ্যার মাঝে স্পষ্ট সীমারেখা নির্ধারণকারী। এই উপাধি হজরত ওমর (রা.)-এর সত্যপ্রেম ও সত্যের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার গুণ প্রকাশ করে। নিঃসন্দেহে তিনি এই গুণে অত্যন্ত উচ্চমর্যাদার অধিকারী ছিলেন। সত্যের ব্যাপারে তিনি কারও মর্যাদা, প্রভাব বা অবস্থানের পরোয়া করতেন না, নিজের প্রাণ বা সম্পদের ক্ষতির ভয়ও করতেন না।

তার মহামানবীয় সত্তা ছিল দারিদ্র্যের প্রতীক। আর তার জীবন ছিল সত্য ও নিষ্কলুষতার জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। তিনি ছিলেন রাসুল (সা.)-এর সত্যিকারের প্রেমিক, ইসলাম ও মুসলমানদের একনিষ্ঠ সেবক। সুপরিকল্পনা, তীক্ষè বুদ্ধি, সাহস, উদারতা, মর্যাদা, ন্যায়বিচার, আল্লাহর ভয়, পরকালীন জীবনের ভাবনা এবং মুসলমানদের অধিকার রক্ষার পূর্ণ দায়িত্বশীলতার গুণে তিনি ভূষিত ছিলেন।

রাসুলুল্লাহ (সা.) ওমর (রা.)-এর কৃতিত্ব ও ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে বলেছেন, ‘যদি আমার পরও নবুয়তের ধারা চলমান থাকত, তাহলে আমার পর ওমর ইবনে খাত্তাব নবী হতো।’ (সুনানে তিরমিজি) যদি হজরত ওমর (রা.)-এর মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়ে আর কোনো হাদিস নাও থাকত, তাহলে এই একটি হাদিসই তার মর্যাদা প্রকাশ করার জন্য যথেষ্ট ছিল। অথচ হাদিস ভাণ্ডারে তার মর্যাদা সংক্রান্ত বহু হাদিস রয়েছে।

এই হাদিস থেকে জানা যায়, যে গুণাবলি নবীদের মধ্যে থাকে, মহান আল্লাহ ওমর (রা.)-কেও সেসব গুণাবলি দ্বারা ভূষিত করেছিলেন। যদি তার বংশপরম্পরা পরীক্ষা করা হয়, তবে স্পষ্ট হয় যে, তিনি কুরাইশ বংশের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। সমগ্র আরব ভূমিতে কুরাইশরা নেতৃত্ব ও মর্যাদায় ছিল সবার ওপরে। যদিও আরবরা বংশপরম্পরা রক্ষায় অত্যন্ত সচেতন ছিল, কিন্তু কুরাইশরা এই বিষয়ে সাধারণ আরবদের চেয়েও বেশি যত্নবান ছিল। এই কুরাইশ বংশ থেকেই রাসুলুল্লাহ (সা.)-এরও আগমন হয়েছিল। ফলে যে গুণাবলির কারণে কুরাইশরা অন্যান্য গোত্রের ওপর প্রাধান্য পেয়েছিল, সেসব গুণাবলি বংশগতভাবে হজরত ওমর (রা.)-এর মধ্যেও বিদ্যমান ছিল।

এরপর ওমর (রা.)-এর বেড়ে ওঠা, জীবনের অভিজ্ঞতা এবং মানুষের সঙ্গে মেলামেশার মাধ্যমে এসব বংশগত গুণাবলি আরও উজ্জ্বল হয় এবং আরও বহু কৃতিত্ব ও গুণাবলি অর্জিত হয়। ওমর (রা.)-এর জীবনকে তিনটি সময়ে ভাগ করা যায়। এক. কুফরের সময়কাল, যা প্রায় তেইশ বছরের বেশি সময় অর্থাৎ শৈশব ও যৌবনের প্রারম্ভিক সময়। দুই. ইসলাম গ্রহণের পর থেকে খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ পর্যন্ত, যা প্রায় বাইশ বছরের কাছাকাছি সময়। তিন. শাসনকাল থেকে শাহাদাত পর্যন্ত, যা প্রায় দশ বছরের সময়কাল।

এই তিন সময়ের প্রতিটি পর্যায়েই তার ব্যক্তিত্বে এমন সব কৃতিত্ব ও গুণাবলি বিদ্যমান ছিল, যার কারণে তিনি তার সমসাময়িকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদায় অগ্রগণ্য ছিলেন। কুফরের যুগে তার শৈশব আরবদের রীতিনীতির মতো উট চরানোর মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। অতঃপর সেই সময়ের মানদণ্ড অনুযায়ী তিনি পড়ালেখা ও উৎকৃষ্ট বিদ্যা-বুদ্ধি অর্জনে মনোযোগ দেন। এর পাশাপাশি কুস্তি, শারীরিক শক্তি, ঘোড়সওয়ারি, যুদ্ধবিদ্যা ও সামরিক কৌশল, প্রভাবশালী বক্তব্য, বাগ্মিতা ও অলঙ্কারশাস্ত্র, সঠিক ও দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, সঠিক সময়ে সঠিক পরিকল্পনা, সাহসিকতা ও বীরত্ব, নির্ভীকতা এবং মানুষ চেনার অসাধারণ ক্ষমতার মতো বহু গুণাবলি তার মাঝে প্রকাশিত হয়।

তার দ্বিতীয় উজ্জ্বল সময়কাল ছিল ইসলামের যুগ। ইসলামের আলো এবং রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সান্নিধ্যের বরকতে তার গুণাবলি ও চরিত্র আরও উজ্জ্বল ও পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। তার এমন অবস্থা হয়েছিল যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘোষণা করেন, ‘আল্লাহ ওমরের অন্তর ও জিহ্বায় সত্য প্রবাহিত করে দিয়েছেন।’ অর্থাৎ তার অন্তরে যা উদয় হবে তাই সত্য হবে এবং তার জিহ্বা থেকে যা উচ্চারিত হবে তা সত্য বৈ কিছু হতে পারে না।

বহুবার এমন ঘটেছে যে, ওমর (রা.)-এর মতের সঙ্গে মিল রেখে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর ওহি নাজিল হয়েছে। যেমন বদরের যুদ্ধ বন্দিদের বিষয়ে, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর স্ত্রীদের পর্দার বিধান সংক্রান্ত বিষয়ে। এগুলো থেকে তার অন্তরে সত্য উদয় হওয়ার গুণটি পূর্ণমাত্রায় বিকশিত হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে।

তৃতীয় সময়কাল, যা ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ ও গৌরবময় ছিল, তা হলো তার খেলাফত ও শাসনকাল। এ সময় তার ব্যক্তিত্ব থেকে অসাধারণ কৃতিত্ব প্রকাশ পায়। একজন সফল ও ন্যায়পরায়ণ শাসকের জন্য যেসব গুণ ও যোগ্যতা প্রয়োজন, তা তার মধ্যে পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান ছিল। অথচ তার পরিবারে এর আগে কখনো কেউ শাসক হয়নি, যাতে শাসন কুশলতা সম্পর্কে তার কোনো ধারণা তৈরি হতে পারে। শৈশবে যখন তিনি উট চরাতেন, তখন শাসনকাজ শেখার প্রশ্নই ওঠে না। তা ছাড়া আরবের হিজাজ অঞ্চলে বহু শতাব্দী ধরে কোনো রাজ্য-রাজার ব্যবস্থাও বিদ্যমান ছিল না।

তার জীবনে শাসন কুশলতা শেখার পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও তিনি এমন সব শাসননীতির ভিত্তি স্থাপন করেন, যা কেয়ামত পর্যন্ত অপরিবর্তনীয় থাকবে। তিনি এমন শাসনপদ্ধতি গ্রহণ করেন, যা একটি সফল সরকারের জন্য অপরিহার্য, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, সুপরিকল্পনা ও প্রজ্ঞা, ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা ও সমতা, গাম্ভীর্য, অশান্তি দমন করে শান্তি প্রতিষ্ঠা, যোগ্য ও সৎ ব্যক্তিদের উৎসাহ প্রদান, আত্মীয়প্রীতি থেকে বিরত থাকা এবং পর্যাপ্ত সম্পদ থাকা সত্ত্বেও নিজের জন্য অত্যন্ত সাদামাটা এবং দরিদ্রসুলভ ও সংযমী জীবনযাপন, এসবই ছিল তার গুণাবলি।

ন্যায়বিচারে তিনি এমন উচ্চ মানদণ্ড স্থাপন করেন যে, ন্যায়বিচারের প্রতীক বলে পরিচিত নওশেরওয়াহর যুগেও ইতিহাসে কিছু অবিচারের ঘটনা পাওয়া যায়, কিন্তু ওমর (রা.)-এর যুগের ইতিহাস এমন একটি ঘটনাও পেশ করতে পারেনি, যাতে অবিচারের সামান্য কিছু পাওয়া যায়। ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে তিনি নিজের, আত্মীয়স্বজনের এমনকি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদেরও কোনো প্রকার ছাড় দিতেন না। ন্যায়ের ক্ষেত্রে তার কাছে সবাই সমান ছিল।

তার শাসনামলে তার জীবনযাপন এমন সহজ ছিল যে, তিনি যে খলিফা এটা বোঝার বাহ্যিক কোনো লক্ষণ ছিল না। তিনি সাধারণ খাবার খেতেন। প্রায়ই জবের রুটি জায়তুন তেল দিয়ে খেতেন। খসখসে মোটা তালি দেওয়া কাপড় পরতেন। একবার তার জামায় বারোটি তালি পাওয়া গিয়েছিল। রাতের বেলায় তিনি নিঃশব্দে শহরে ঘুরে বেড়াতেন, মানুষের অভিযোগ খোলা মনে শুনতেন এবং সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের সাহায্য করতেন। মুসলমানদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা করতেন এবং অমুসলিমদের সঙ্গেও সদ্ব্যবহার করতেন।

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION